প্রকাশিত : ২১ জুন, ২০২০ ১৬:১৮

আমিই তো বাবা

মোসলেম উদ্দিন, হিলি (দিনাজপুর)
আমিই তো বাবা

বাবা যে কেমন, তার স্বাদ বাই কেমন হয়। তা তো কোন দিন উপলদ্ধি করতে পারিনি। কেননা সেই দেড় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। তবে আমি একজন বাবা হতে পেরেছি। দুটি মেয়ের জন্য নিজের সর্বোচ্চ উজার করে দিয়ে শান্তি পাই। তাদের ঘিরে আমার বেঁচে থাকা। তাদের মুখে হাসি ফোটানোই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। শত কল্পনা-জল্পনা তাদের নিয়ে। তাদের স্বর্থকতা আমার স্বার্থকতা। সবাই তাদের ছেড়ে গেছে কিন্তু আমি যাইনি। কেননা আমি যে বাবা। যে দশ মাস, দশ দিন গর্ভে রেখে ছিলো, সেও তো ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু আমি যাইনি, আমি যে একজন বাবা।

দুইটি মেয়ের মুখ দেখলে জগতের সকল দু:খ-কষ্ট ভুলে যাই। ক্ষুধা লাগলে ভাল-মন্দ, আত্বীয়-স্বজন ভাই-বোন প্রতিবেশি এমন কি মাকেও বিরক্ত মনে হয়। কিন্তু এমন সময় দুই মেয়ে যদি কাছে ছুটে আসে বা কোলে উঠে। তখন ক্ষুধা বা বিরক্ত পালিয়ে যায়। কান্ত শরীর শান্ত হয়ে যায়। তাদের হাসি মুখ আর কমল হাতের ছোঁয়ায় ভিতরে কি যেন এক অনুভতি কাজ করে। কোলে তুলে নিয়ে বুকের মাঝে জোড়িয়ে ধরলে পৃথিবীর সব ভুলে যায়। এটাই তো বাবার প্রকৃত রুপ।

প্রতিদিন কোন না কোন প্রোগ্রামে যাই। অনেকেই ভাল ভাল খাবার খেতে দেয়। তখন দুটি চাঁদের মত মুখ আমার সামনে ভেসে উঠে। খেতে পারি না। মন বলে এই খাবারটুকু যদি নিয়ে গিয়ে তাদের মুখে তুলে দিতে পারতাম? না খেয়ে প্যাকেট করে ছুটে আসি বাড়িতে। মীম-রুকু মা খাবার নিয়ে এসেছি। নিজ হাতে যখন তাদের খাবার খুলে খাওয়ায় তখন কিযে তৃপ্তি বোঝাতে পারবো না।

রুকুর বয়স তিন বছর মীমের বয়স আট বছর রেখেই চলে গেলেন তাদের মা না ফেরার দেশে। কাঁধে পড়লো সকল দায়িত্ব। একটি রাত তাদের ছেড়ে বাহিরে থাকিনি। তাদের যে মা নেই। আমিই মা, আমি যে বাবা। এইতো দুই বছর আগে। বন্ধুদের সাথে সুন্দর বন দেখতে যাবো। রাত ৯ টায় জয়পুরহাট রেলষ্টেশনে সীমান্ত ট্রেনে উঠলাম। ভেসে উঠলো দুটি মাসুম বাচ্চার মুখ। বন্ধুদের কাউকে না বলে ট্রেন থেকে নেমে ছুটতে থাকলাম আমার বাচ্চাদের কাছে। মা নেই, আমিই তো ওদের সব। আমি যে তাদের একমাত্র ভরসা।

রাত দুইটা রুকুর শরীরে প্রচন্ড জ্বর। গাঁ পুড়ে যাচ্ছে, তীব্র জ্বরে মেয়ে আমার ভুল বকছে। এতো রাত কি করি, ছোট বাচ্চা সব ঔষুধ তো খাওয়ানো যাবে না। মাথায় পানি আর গামছা ভিজিয়ে শরীর মুছে দিচ্ছি। কিছুতেই মেয়ের জ্বর নামছে না।নিরুপায় হয়ে বাচ্চাকে বুকে নিয়ে সেই গভীর রাতে ছুটে বের হলাম ডাক্তার বা ঔষুধের দোকানের সন্ধানে। বাজে রাত তিনটা, পুরো শহর বাচ্চাকে বুকে নিয়ে ঘুরছি। ওতো রাতে কি আর এসব পাওয়া যায়। দিশকুল না পেয়ে এক ডাক্তারে বাড়ির দরজায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। দরজা ধাক্কা দিয়ে,অনেক ডাকাডাকি করে তাকে ঘুম থেকে তুললাম। বিশেষ অনুরোধ করে বাচ্চার চিকিৎসা নিলাম। জ্বর কমলো, বুকের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লো মেয়ে। আর আমার বুকে ফিলে এলো স্বস্তি।  

তাদের স্বার্থকতা, আমার স্বার্থকতা। ৫ম শ্রেণীর ফল প্রকাশ। মীম, বাবা আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। ৮ম শ্রেণীর ফল প্রকাশ। মীম, বাবা আমি আবারও জিপিএ-৫ পেয়েছি। একের পর এক মেয়ের সাফল্যতা দেখে নিজেকে একজন গর্বিত আর অহাংকারী বাবা মনে করছি। দুনিয়ার সকল স্বার্থকতা মনে হচ্ছে আমার এই কুড়ে ঘরে বাসা বাঁধছে

উপরে