পার্বতীপুরে পুস্তক প্রকাশনির কাছে জিম্মি শিক্ষার্থী অভিভাবক

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে হাইস্কুল ও মাদরাসায় পাঠদান করা হচ্ছে না সরকারের দেয়া বিনামূল্যের গ্রামার ও ব্যাকরণ বই। এর পরিবর্তে পাঠদান করা হচ্ছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন লিঃ (অক্ষরপত্র), লেকচার পাবলিকেশন লিঃ, অ্যাডভান্স পাবলিকেশন লিঃ ও কাজল ব্রাদার্স লিঃ সহ বিভিন্ন প্রকাশনির গ্রামার ও ব্যাকরন। ফলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিন্ন মেধা বিকাশের জন্য সরকারের যে লক্ষ্য তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সেই সাথে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি গাইড ও নোট বই নির্ভর হয়ে পরছে তারা।
এসব প্রকাশনীর নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিনিধিরা প্রতিটি স্কুল ও মাদরাসার প্রধান শিক্ষক অথবা ম্যানেজিং কমিটিকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দেয়ার বিনিময়ে ৬ষ্ঠ হতে ৯ম ও ১০ম শ্রেণির পর্যন্ত পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত করছে তাদের গ্রামার ব্যাকরণ বই। এসব মোটা অংকের অর্থ লেনদেনের চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে ইতোমধ্যে।
জানা গেছে, উপজেলায় ৭৫টি মাধ্যমিক ও ৩৯টি মাদরাসা রয়েছে। এর মধ্যে ৬৮টি হাইস্কুল ও ৩৫টি মাদরাসায় এনসিটিবি’র প্রকাশিত গ্রামার ব্যাকরণ বইয়ের পরিবর্তে বিভিন্ন প্রকাশনির গ্রামার ব্যাকরণ কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে অভিভাবকদের। সেই সাথে এসব গাইড বই শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও প্রকাশনিসমুহ গ্রামার, ব্যাকরণের সাথে তাদের গাইড বই ক্রয়ে বাধ্য করছে অভিভাবক অথবা শিক্ষার্র্থীদের।
উপজেলার ঢাকুলা হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, আমি গরিব মানুষ। সরকার আমার মেয়ের জন্য সব পাঠ্য বই বিনামূল্যে দিয়েছে। এতে আমি খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু এখন শুনতে পাচ্ছি সরকারের দেয়া গ্রামার ব্যাকরণ বই এ স্কুলে পড়ানো হবে না। পড়ানো হবে প্রকাশনির গ্রামার ও ব্যাকরণ বই। এর সাথে সব বইয়ের জন্য গাইড বইও কিনতে হবে। উপজেলার রোস্তম নগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের হেড স্যার প্রতিবছর প্রকাশনির গ্রামার, ব্যাকরণ ও গাইড বইয়ের জন্য বুকলিষ্ট দিয়ে থাকেন। এবারও তিনি ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রকাশনির কাছে ঘুষ নিয়েছেন বলে শুনেছি।
শুধু রোস্তম নগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নয় দাগলাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, যশাই উচ্চ বিদ্যালয়সহ প্রায় প্রত্যেক বিদ্যালয়ের প্রধানদের সাথে চুক্তির বিনিময়ে টাকা দিয়েছে এসব প্রকাশনি। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে এ টাকা পরিমান ছিলো সর্বনিম্ন ৫০হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২লাখ টাকা পর্যন্ত। প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অভিযোগ তাদের হাতে বুকলিষ্ট তুলে দিয়ে সেসব বই দ্রুত কিনতে বলা হয়েছে বিদ্যালয় থেকে।
এদিকে, শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি নোট গাইড সম্পর্কে বৃহস্পতিবার যে মন্তব্য করেছেন এখানকার অভিভাবক মহল তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। ‘আমরা নোট গাইড ব্যবস্থা বন্ধ করতে চাই। বর্তমান সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থায় নোট গাইডের কোন প্রয়োজন নেই’ এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কম পক্ষে ১০ জন সন্তোষ প্রকাশ করে জানান, যুগ যুগ ধরে আমাদের এখানে নোট গাইড চলে আসছে। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় নোট গাইডের কুফল সম্পর্কে অবগত আছেন। এ কারণে দ্রুত এ ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান তারা।
এসব অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যায় করে পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে সরবরাহ করে থাকে। এসব বইয়ের মধ্যে এনসিটিবি’র গ্রামার ও ব্যাকরণ বইও রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি এনসিটিবি’র গ্রামার ব্যাকরণ বই বাদ দিয়ে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে প্রকাশনির গ্রামার ব্যাকরণ বই পার্বতীপুরে পাঠদান করা হচ্ছে।
এব্যাপারে জানতে চাইলে পার্বতীপুরের অন্তত ৬জন পুস্তক বিক্রেতা বলেছেন, তাদের পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি বলছে, ডোনেশন বা ঘুষ দিয়ে কোন ধরণের বই পাঠ্য করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন লিঃ, লেকচার পাবলিকেশন লিঃ, অ্যাডভান্স পাবলিকেশন লিঃ ও কাজল ব্রাদার্স লিঃ পার্বতীপুরে লাখ লাখ টাকা স্কুল মাদরাসায় ঘুষ দিয়ে তাদের বই পাঠ্য করেছে এবার। এসব প্রকাশনি তাদের স্বার্থে পুস্তক বিক্রেতাদের ব্যবহার করছে শুধুমাত্র।
সমিতি ও প্রকাশনি একই সুরে বলছে গায়ের মূল্যে বই বিক্রি করতে হবে। কিন্তু প্রকাশনির প্রতিনিধিরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে কমিশন ও বইয়ের মূল্য বলে দিয়ে পুস্তক বিক্রেতাদের হেনস্তা করছে। এসব পুস্তক বিক্রেতা আরও বলেন, সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যায়ে পাঠ্যবই মূদ্রন করে বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে সরবরাহ করলেও এ ক্ষেত্রে প্রকাশনিগুলো টাকার জোরে শিক্ষকদের কিনে নিয়ে সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।
পুস্তক বিক্রেতারা আরও অভিযোগ করেন, আগে পাঠ্যপুস্তকে সরকার বড় অংকের ভর্তূগি দিতো। কিন্তু পুস্তক সমিতির একটি দূর্নীতিবাজ চক্র নানা কারসাজির মাধ্যমে সাধারণ পুস্তক বিক্রেতাদের কম কমিশনে অথবা কমিশন বঞ্চিত করে বই সরবরাহ নিতে বাধ্য করতো। এর প্রভাব পড়তো শিক্ষার্থী অথবা তাদের অভিভাবক পর্যায়ে। ১৯৯৬ সালে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে চরম নৈরাজ্য হয়। ১৪ টাকার বই বিক্রি হয় ৫০/৫৫ টাকায়। একইভাবে সব শ্রেণির সব বই ৪/৫ গুনের অধিক মূল্যে বিক্রি হয়। এসময় সমিতি পুরোপুরি নিরব থেকেছে। ই নৈরাজ্যের পেছনে যারা জড়িত ছিলেন তারা আজও সক্রিয় আছেন। কিন্তু সাংগঠনিক পর্যায়ে অথবা আইনগতভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন কথা আমরা জানতে পারিনি।এসব পুস্তক বিক্রেতা আরও বলেন, কোন যাদুমন্ত্রে মাত্র কয়েকটি প্রকাশনি সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে যাচ্ছে তার তদন্ত হলে সব রহস্য উম্মোচিত হবে।
এদিকে পুস্তক বিক্রেতা সমিতি পার্বতীপুর শাখার সভাপতি আবদুল কাদির ও সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীর কাছে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সমস্যা হচ্ছে মূলতঃ সমিতি নিয়ে। পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এ দুটি সংগঠন একীভূত থাকায় প্রভাবশালী প্রকাশনীরা সারাদেশের পুস্তক বিক্রেতাদের এক প্রকার কোনঠাসা করে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। তাদের যে কোন অন্যায় অনৈতিক পদক্ষেপ সারাদেশের সাধারণ পুস্তক বিক্রেতাদের মুখ বুঝে সহ্য করতে হচ্ছে। আমরাও এসবের প্রতিকার চাই।